"দশচক্রে ভগবান কিংবা ভূত" এর বিশ্লেষণ
১. দশচক্রের অর্থ
"দশচক্র" বলতে বোঝানো হয়েছে সমাজের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সংঘ। এটি সেই দশজন বা সমাজের এমন একটি শ্রেণির প্রতীক যারা কোনো বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয় বা মতামত প্রদান করে। এখানে দশ সংখ্যাটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের নিয়ন্ত্রণকারী বা প্রভাবশালী অংশকে নির্দেশ করে।
২. ভগবান এবং ভূতের প্রতীক
ভগবান: এখানে ভগবান বলতে সেই বিশ্বাস, সিস্টেম বা ধারণা বোঝানো হয়েছে যা সমাজ বা ব্যক্তির দ্বারা গৃহীত এবং পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ, কোনো কিছুকে যখন সমাজের একটি গোষ্ঠী "ভগবান" বা পবিত্র বলে গণ্য করে, তখন তা সম্মানিত এবং গ্রহণযোগ্য হয়।
ভূত: "ভূত" শব্দটি এখানে ভ্রান্ত ধারণা বা অপ্রত্যক্ষ সত্যকে নির্দেশ করে। যখন কোনো বিষয়কে ভয়ঙ্কর বা অমঙ্গলজনক হিসেবে দেখা হয়, তখন তা সমাজে ভীতিকর হয়ে ওঠে এবং প্রত্যাখ্যাত হয়।
৩. বাক্যটির সারমর্ম
"দশচক্রে ভগবান কিংবা ভূত" বাক্যটি বোঝাতে চায় যে সমাজের যেকোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিরা যখন কোনো বিষয়কে একত্রে মেনে নেয় বা স্বীকৃতি দেয়, তখন সেই বিষয়টি ভালো বা মন্দ বলে প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ, সমাজের সম্মিলিত মতামত, বিশ্বাস বা কুসংস্কার কোনো বিষয়কে "ভগবান" (অর্থাৎ পবিত্র এবং সত্য) অথবা "ভূত" (অর্থাৎ ভ্রান্ত এবং মিথ্যা) বানিয়ে দিতে পারে। এটা মানুষকে বোঝাতে চায় যে সমাজের প্রচলিত মতামত অনেক সময় সত্য নয় বরং এটি সমাজের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি।
৪. রবীন্দ্রনাথের সমাজ-সমালোচনার প্রতিফলন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বক্তব্যে সমাজের কুসংস্কার, সামাজিক গোঁড়ামি এবং প্রচলিত মানসিকতার সমালোচনা রয়েছে। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, মানুষ অনেক সময় যুক্তিহীনভাবে কোনো কিছুকে "সত্য" বা "ভুল" হিসেবে মেনে নেয়, শুধুমাত্র সমাজের চাপের কারণে। এখানে ব্যঙ্গাত্মকভাবে সমাজের চিন্তাশক্তির সীমাবদ্ধতা ও আত্ম-অনুসন্ধানের অভাব তুলে ধরা হয়েছে।
৫. আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান যুগেও এই বাক্যটি প্রাসঙ্গিক। আধুনিক সমাজেও অনেক সময় প্রচলিত মতামত বা গোষ্ঠীগত চিন্তাভাবনা ব্যক্তি ও সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক সময় যুক্তি বা সত্য না বুঝেই মানুষ কোনো বিষয়কে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করে। রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি সেই ধরণের পরিস্থিতির একটি চমৎকার ব্যাখ্যা।
উপসংহার
"দশচক্রে ভগবান কিংবা ভূত" এই বাক্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজ-ভাবনা ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তুলেছে। এটি বোঝায় যে সমাজের গোষ্ঠীগত চিন্তাভাবনা এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে কোনো বিষয়কে স্বীকৃতি দেওয়া বা প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকে অস্পষ্ট করে তোলে।
0 মন্তব্যসমূহ
আপনাকে জানাই ধন্যবাদ