২০২৪ সালের এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্সে ভারত তৃতীয় স্থানে
উঠে এসেছে, যা এই প্রথমবার
জাপানকে ছাড়িয়ে গেছে। এই তালিকা তৈরি
করেছে অস্ট্রেলিয়ান থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, লোউই ইনস্টিটিউট। এই
সূচকে এশিয়ার ২৭টি দেশ এবং
অঞ্চলকে সামরিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, কূটনৈতিক প্রভাব, সাংস্কৃতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের শক্তি ও প্রভাবের ভিত্তিতে
মূল্যায়ন করা হয়।
ভারতের এই অগ্রগতির প্রধান
কারণ হলো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার,
জিডিপি বৃদ্ধি, এবং সামরিক আধুনিকীকরণ।
তবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে,
ভারতের সম্পদের পরিমাণের তুলনায় তার প্রভাব এখনও
সীমিত, এবং পূর্ণ শক্তি
অর্জনের জন্য আরও সম্ভাবনা
রয়েছে
· সামরিক ক্ষমতা (Military Capability): একটি দেশের সামরিক শক্তি ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতা।
ভারতের সামরিক ক্ষমতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে প্রধানত নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ:
- সামরিক আধুনিকীকরণ: ভারত তার সামরিক সরঞ্জাম এবং অস্ত্রশস্ত্র আধুনিকীকরণের দিকে জোর দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করা।
- পরমাণু শক্তি: ভারত একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ, এবং এটি তার সামরিক ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এর পাশাপাশি ভারত দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (ICBM) তৈরি করেছে, যা পরমাণু ক্ষমতা প্রদান করতে সক্ষম।
- মিলিটারি রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট: ভারতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা ডিআরডিও (Defence Research and
Development Organisation) নতুন প্রযুক্তি ও অস্ত্র তৈরি এবং বিদ্যমান অস্ত্রের উন্নতির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই রিসার্চের ফলে নতুন মিসাইল ও ড্রোন প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে।
- সামরিক বাজেট বৃদ্ধি: ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সামরিক সরঞ্জাম কেনা এবং বাহিনীর প্রশিক্ষণে ব্যয় করা হচ্ছে।
- কৌশলগত সামরিক অংশীদারিত্ব: ভারত অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং যৌথ মহড়া বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ফ্রান্সের সাথে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি ভারতের সামরিক অবস্থানকে মজবুত করেছে।
- স্বদেশী প্রতিরক্ষা উৎপাদন: ভারত "মেক ইন ইন্ডিয়া" উদ্যোগের মাধ্যমে স্বদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি ও উৎপাদনকে উৎসাহিত করছে, যার ফলে নির্ভরশীলতা কমেছে এবং উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে।
এই উপাদানগুলোর মাধ্যমে ভারত তার সামরিক শক্তিকে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে এবং এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সে এর সামরিক ক্ষমতার মান বৃদ্ধি পেয়েছে
· প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক (Defence Networks): অন্যান্য দেশের সাথে সামরিক সহযোগিতা ও সম্পর্ক।
ভারতের প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভারতের সামরিক প্রভাব ও আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে শক্তিশালী করেছে। এর প্রধান উপাদানগুলো নিম্নরূপ:
- কৌশলগত প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব: ভারত যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় শক্তিধর দেশের সাথে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে, QUAD (Quadrilateral
Security Dialogue) এর মাধ্যমে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সামরিক মহড়া পরিচালনা করছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে।
- বহুপাক্ষিক প্রতিরক্ষা মহড়া: ভারত নিয়মিতভাবে Malabar ও RIMPAC এর মতো বহুজাতিক নৌমহড়ায় অংশগ্রহণ করে, যা সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তা জোরদার করতে সাহায্য করে। এ ধরনের মহড়া অন্যান্য দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাথে সমন্বয় বাড়াতে সহায়ক।
- প্রতিরক্ষা চুক্তি: ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথে COMCASA
(Communications Compatibility and Security Agreement) এবং BECA (Basic Exchange
and Cooperation Agreement) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা নিরাপত্তা এবং সামরিক তথ্য ভাগাভাগির সুবিধা প্রদান করে। এছাড়া ফ্রান্সের সাথে রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি ভারতের সামরিক সক্ষমতাকে শক্তিশালী করেছে।
- ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল: ভারত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই অঞ্চলে নৌসেনার শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত সুরক্ষিত সমুদ্রসীমা নিশ্চিত করছে এবং আঞ্চলিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অবদান রাখছে।
- আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা: ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সামরিক প্রশিক্ষণ বাড়িয়েছে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হয়েছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তায় তার অবদান বাড়ছে(
এই প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ভারত তার সামরিক প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সে তার শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।
· অর্থনৈতিক সক্ষমতা (Economic Capability): দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতা, যেমন জিডিপি এবং বাণিজ্য।
ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো:
- মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) বৃদ্ধি: ভারতের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী GDP বৃদ্ধি তার অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে আরও বাড়িয়েছে। ভারত বর্তমানে ক্রয়ক্ষমতা সমতার (PPP) দিক থেকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, যা তার আন্তর্জাতিক প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। ২০২৪ সালের এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ৪.২ পয়েন্ট বেড়েছে(
- উৎপাদন খাতের উন্নয়ন: ভারত "মেক ইন ইন্ডিয়া" উদ্যোগের মাধ্যমে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এর ফলে দেশে নতুন শিল্প ও অবকাঠামো গড়ে উঠছে, যা অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করছে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ও পরিষেবা খাতে ভারতের দক্ষতা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, যা অর্থনীতির এক বড় ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।
- বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ: ভারত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সফল হয়েছে এবং তার বৈশ্বিক বাণিজ্য অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি ও অংশীদারিত্ব ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে মজবুত করেছে, যা এশিয়া অঞ্চলে তার অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়িয়েছে।
- জনসংখ্যাগত সুবিধা: ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বৃহৎ শ্রমশক্তি ও ভোক্তা বাজার গড়ে উঠেছে। দেশের তরুণ জনসংখ্যা অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হিসেবে কাজ করছে(
- প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন: ভারত প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনে অগ্রসর হচ্ছে, বিশেষ করে স্টার্টআপ খাত এবং ডিজিটাল অর্থনীতিতে। এর ফলে ভারতের অর্থনীতিতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তাকে এগিয়ে রাখছে।
এই উপাদানগুলোর সমন্বয়ে ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সে ভারতের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হয়েছে।
· অর্থনৈতিক সম্পর্ক (Economic Relationships): অন্যান্য দেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও প্রভাব।
ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তার বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রভাবকে শক্তিশালী করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো হলো:
- মহৎ বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্ক: ভারত অনেক দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেমন জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের সাথে। এতে করে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ভারতের অবস্থান আরও মজবুত হয়েছে।
- দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক অংশীদারিত্ব: ভারত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ফোরামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত BRICS, G20, এবং ASEAN এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থায় অংশগ্রহণ করে তার বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে বিস্তৃত করেছে।
- বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) বৃদ্ধি: ভারত বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল হয়ে উঠেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং, তথ্যপ্রযুক্তি এবং স্টার্টআপ সেক্টরে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, এবং সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ ভারতে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
- প্রতিযোগী মূল্য সুবিধা: ভারতের বিশাল শ্রমবাজার এবং তুলনামূলকভাবে কম শ্রমিকের খরচ অন্যান্য দেশগুলোর সাথে ভারতের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে উন্নত করেছে। ফলে ভারতীয় পণ্য ও সেবা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেয়েছে।
- ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল: ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের ভূ-অর্থনৈতিক কৌশল তার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। ভারত এই অঞ্চলে অবাধ ও সুরক্ষিত বাণিজ্য রুটকে সমর্থন দিয়ে তার কৌশলগত অংশীদারিত্বকে শক্তিশালী করেছে।
- প্রযুক্তিগত ও উদ্ভাবনী সহযোগিতা: ভারত তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, এবং উদ্ভাবনী খাতে অনেক দেশের সাথে অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত এবং ইসরায়েলের মধ্যে কৃষি এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
এসব উপাদান ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে তুলেছে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব আরও বিস্তৃত হয়েছে
· কূটনৈতিক প্রভাব (Diplomatic Influence): বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে দেশের কূটনৈতিক কার্যক্রম।
ভারতের কূটনৈতিক প্রভাব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন বিষয়ে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর মূল বিষয়গুলো হলো:
- বৈশ্বিক নেতৃত্বে সক্রিয় ভূমিকা: ভারত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যেমন G20, BRICS, এবং United Nations। ২০২৩ সালে ভারত G20 এর সভাপতিত্ব করেছে, যেখানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নেতৃত্ব দিয়েছে।
- আঞ্চলিক নেতৃত্ব: ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক কূটনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করেছে। SAARC, BIMSTEC,
এবং Indian Ocean Rim Association
(IORA) এর মতো সংগঠনগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে।
- কৌশলগত অংশীদারিত্ব: ভারতের কূটনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, এবং রাশিয়ার মতো প্রধান দেশগুলোর সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দেশগুলোর সাথে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতার মাধ্যমে ভারত তার প্রভাব বিস্তার করেছে।
- ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল: ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবাধ ও সুরক্ষিত বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। QUAD (ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) এর মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়েছে।
- উন্নয়নমূলক কূটনীতি: ভারত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তার প্রভাব বৃদ্ধির জন্য উন্নয়নমূলক সহায়তা ও কূটনীতি ব্যবহার করছে। আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে উন্নয়নমূলক প্রকল্প, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, এবং মানবিক সহায়তার মাধ্যমে ভারত তার প্রভাব বৃদ্ধি করেছে।
- কৌশলগত স্বাধীনতা: ভারত একটি কৌশলগত স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে, যা তাকে বৈশ্বিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে একটি নিরপেক্ষ এবং দায়িত্বশীল অবস্থান দিতে সহায়তা করেছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং চীনের প্রভাবের বিরুদ্ধে তার নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করেছে(
· সাংস্কৃতিক প্রভাব (Cultural Influence): দেশের সাংস্কৃতিক প্রভাব ও সুনাম।
ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মূল উপাদানগুলো হলো:
- বলিউড এবং বিনোদন: ভারতের চলচ্চিত্র শিল্প, বিশেষ করে বলিউড, বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব বিস্তার করেছে। বলিউডের সিনেমা, গান এবং নৃত্য বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় এবং এটি ভারতের সংস্কৃতিকে বৈশ্বিক স্তরে তুলে ধরছে। এছাড়া ভারতের সিনেমা শিল্প বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সাফল্য অর্জন করেছে এবং বৈশ্বিক অডিয়েন্সকে আকৃষ্ট করছে।
- যোগ এবং আয়ুর্বেদ: যোগ (Yoga) এবং আয়ুর্বেদ (Ayurveda) ভারতের প্রাচীন জ্ঞান এবং স্বাস্থ্য পদ্ধতি, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। প্রতি বছর ২১ জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালন করা হয়, যা ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাবের একটি বড় উদাহরণ। ভারতের যোগ প্রশিক্ষক ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি বহু দেশের মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
- ভারতীয় রন্ধনশৈলী: ভারতীয় খাবার এবং মশলার জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতীয় রেস্তোরাঁ এবং রান্নার পদ্ধতি ইউরোপ, আমেরিকা, এবং অন্যান্য অঞ্চলে একটি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক অবদান রাখছে। ভারতের মশলাযুক্ত খাবার ও রান্নার ধরণ বৈশ্বিক খাদ্য সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করছে।
- সফট পাওয়ার এবং সাংস্কৃতিক কূটনীতি: ভারত সাংস্কৃতিক কূটনীতি এবং সফট পাওয়ারকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে তার প্রভাব বিস্তার করছে। Indian Council for
Cultural Relations (ICCR) এর মাধ্যমে ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করছে।
- ধর্মীয় প্রভাব: হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম এবং শিখধর্মের মতো ভারতের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস এবং আচার বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ভারতের ধর্মীয় শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতি বৈশ্বিক আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিভিন্ন দেশের লোকদের মধ্যে ভারতের সংস্কৃতির প্রতি ইতিবাচক ধারণা তৈরি করছে।
- বহুজাতিক সংযোগ এবং ভারতীয় প্রবাসী: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ভারতীয় প্রবাসী (Indian diaspora) ভারতের সংস্কৃতি, ভাষা, এবং ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় প্রবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভূমিকা অনেক দেশে উল্লেখযোগ্য, যা সাংস্কৃতিক সংযোগকে শক্তিশালী করেছে।
এসব উপাদানের মাধ্যমে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভাব বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে, এবং এটি ভারতের সফট পাওয়ার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে
· স্থিতিশীলতা (Resilience): দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।
ভারতের স্থিতিশীলতা (Resilience) এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়, যা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর স্থায়িত্ব, সামাজিক সংহতি, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। ভারতের স্থিতিশীলতার বৃদ্ধি কয়েকটি প্রধান বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে হয়েছে:
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: ভারতের দীর্ঘমেয়াদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নিয়মিত নির্বাচন প্রক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি বড় উদাহরণ। যদিও মাঝে মাঝে রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং আঞ্চলিক সংঘাত দেখা যায়, তবুও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার পরিবর্তন এবং কার্যকর আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া ভারতের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে মজবুত করে তুলেছে।
- অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অর্থনীতি স্থিতিশীলভাবে বেড়েছে, যা GDP বৃদ্ধির হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করেছে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প, যেমন "মেক ইন ইন্ডিয়া" এবং "ডিজিটাল ইন্ডিয়া", দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার অবদান রেখেছে।
- সামাজিক স্থিতিশীলতা: যদিও ভারতের ভেতরে সামাজিক বৈষম্য এবং ধর্মীয় উত্তেজনা রয়েছে, দেশটির সামগ্রিক সামাজিক কাঠামো স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। ভারত বহুজাতি, বহু ধর্ম, এবং বহু সংস্কৃতির দেশ হিসেবে তার সামাজিক ঐক্য বজায় রাখছে। সরকারের বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক প্রকল্প এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা: ভারত একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও, তার দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থাপনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। ভারত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, ভূমিকম্প, এবং ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় উন্নত অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা ব্যবহার করছে, যা স্থিতিশীলতা বাড়িয়েছে।
- কৌশলগত এবং প্রতিরক্ষা স্থিতিশীলতা: ভারতের সামরিক শক্তি এবং প্রতিরক্ষা নীতি তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সক্ষম। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশ হিসেবে ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এই সমস্ত উপাদান ভারতের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে, যা এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সে ভারতের রেটিং বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছে(
· ভবিষ্যত সম্পদ (Future
Resources): দেশের জনসংখ্যা, ভূমি এবং অন্যান্য ভবিষ্যত সম্পদ, যা ভবিষ্যতে দেশের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে
এশিয়া পাওয়ার ইন্ডেক্সে ভারতের ভবিষ্যতের সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো:
- অর্থনৈতিক শক্তি: ভারতের উন্নত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিপুল বাজার এবং বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে একটি হিসেবে ভারতের শক্তিশালী বাজার তাকে শক্তিশালী করে তোলে।
- সামরিক ক্ষমতা: ভারতের সামরিক শক্তি, প্রতিরক্ষা বাজেট এবং আধুনিকীকরণের উদ্যোগ। ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সেনাবাহিনী এবং তার অস্ত্র ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে প্রচুর বিনিয়োগ করছে।
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নীতি স্থিরতা। স্থিতিশীল সরকার দেশটির সামরিক ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে সহায়ক।
- ডেমোগ্রাফিক সুবিধা: ভারতের যুব জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধি, যা ভবিষ্যতের শ্রমশক্তি হিসাবে কাজ করবে।
- টেকনোলজি ও উদ্ভাবন: প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে ভারতের উন্নতি, বিশেষ করে তথ্য প্রযুক্তি, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং ডিজিটাল অর্থনীতি।
- আন্তর্জাতিক সম্পর্ক: ভারতের বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে। এই সম্পর্কগুলো ভারতের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছে।
এই বিষয়গুলো ভারতের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ
আপনাকে জানাই ধন্যবাদ