রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দুর্গাপূজা:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ছিল জমিদার পরিবার, এবং তাঁরা কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পূজার আয়োজন করতেন। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক সামাজিক মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজা হতো অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে, এবং এখানে কবির শৈশবে পূজার আনন্দ তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ঠাকুরবাড়ির পূজা ছিল বেশ রাজকীয়, যেখানে সাহিত্যের সঙ্গে সংস্কৃতির মিলন ঘটত। রবীন্দ্রনাথের লেখালেখিতেও দুর্গাপূজার এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
কবির রচনায় এবং গানগুলিতে বাংলার দুর্গাপূজা নিয়ে অনেক আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বিভিন্ন কবিতায় প্রকৃতি এবং পূজার মিলন ঘটিয়ে এক ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে শারদীয়া আবহাওয়া, কাশফুল, নদীর তীর এবং বাংলার গ্রামের পরিবেশ তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, যা তাঁর সাহিত্যকর্মেও দেখা যায়।
তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার দুর্গাপূজা:
অবিভক্ত বাংলার সময় দুর্গাপূজা ছিল অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সমৃদ্ধ। কলকাতার জমিদার বাড়ি থেকে শুরু করে মফস্বল শহর, এমনকি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হতো। পূজা মানেই ছিল আনন্দ, নাচ-গান, নাটক মঞ্চায়ন, কবিতা পাঠ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মিলনমেলা। পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত এই সময়টা ছিল উৎসবের আবহে ভরা। রাজবাড়ি এবং জমিদার বাড়িগুলোতে ছিল বড় আয়োজন। স্থানীয় লোকেরা এসব পূজায় অংশগ্রহণ করতেন, এবং পুরো বাংলাজুড়ে এর একটি গণজাগরণ লক্ষ্য করা যেত।
বিখ্যাত পূজা কেন্দ্র:
১. কুমারটুলি, কলকাতা: এখানকার প্রতিমা তৈরির খ্যাতি ছিল বিশ্বজুড়ে। এখানকার শিল্পীরা তাদের সূক্ষ্ম কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত ছিলেন এবং এখনও আছেন। কলকাতার প্রতিমা শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল এটি।
২. নবদ্বীপ, নদীয়া: এই জায়গাটি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। দুর্গাপূজার সময় নবদ্বীপে ছিল অপরিসীম ধুমধাম। বিশেষ করে চৈতন্যদেবের জন্মস্থান হওয়ায় এটি অতিরিক্ত গুরুত্ব পেত।
- ঢাকা: অবিভক্ত বাংলার সময় ঢাকায় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। ঢাকা শহরের বড় বড় জমিদার পরিবারগুলোর উদ্যোগে দুর্গাপূজা হতো, যা সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করত।
- রাজশাহী: এই অঞ্চলটিও দুর্গাপূজার জন্য বিখ্যাত ছিল। জমিদারি প্রথার প্রভাবে রাজশাহীতে দুর্গাপূজা ছিল বেশ আড়ম্বরপূর্ণ, এবং এতে স্থানীয় জনসাধারণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল।
- বরিশাল ও খুলনা: এই দুই অঞ্চলেও দুর্গাপূজা পালনের বিশাল ঐতিহ্য ছিল। বরিশালের জমিদার বাড়িগুলোর পূজা ছিল বিশেষ আকর্ষণীয়।
অবিভক্ত বাংলার পূজার আড়ম্বর:
অবিভক্ত বাংলার দুর্গাপূজা ছিল একসময়ে সমস্ত
সমাজকে একত্রিত করার অন্যতম প্রধান
উৎসব। এই উৎসবের সঙ্গে
যুক্ত ছিল আধ্যাত্মিকতা, সামাজিক
ঐক্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।
গ্রাম থেকে শহর, জমিদার
পরিবার থেকে সাধারণ কৃষক,
সবার কাছে দুর্গাপূজা ছিল
এক সর্বজনীন আয়োজন। নিচে অবিভক্ত বাংলার
দুর্গাপূজার আড়ম্বরের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
১. জমিদার ও রাজবাড়ির পূজা:
অবিভক্ত বাংলায় জমিদার ও রাজবাড়ির দুর্গাপূজা
ছিল সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ। জমিদার বাড়িতে যে পূজার আয়োজন
হতো তা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মিলনমেলায়
পরিণত হতো। পূজার প্রধান
আকর্ষণ ছিল বিরাট মন্ডপ,
বিশালাকার প্রতিমা, এবং পূজার সময়ে
বিভিন্ন ধরনের আচার পালন।
·
কলকাতার
শোভাবাজার
রাজবাড়ি:
রাজা নবকৃষ্ণ দেব ১৭৫৭ সালে
কলকাতার শোভাবাজারে প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এই পূজা ছিল
অত্যন্ত ধনী এবং আড়ম্বরপূর্ণ,
যেখানে ইংরেজ শাসকরাও আমন্ত্রিত থাকতেন। এটি ছিল অত্যন্ত
জমকালো এবং এখানে নানা
ধরনের সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম
হতো।
·
জোড়াসাঁকো
ঠাকুরবাড়ি:
রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরবাড়ির পূজাও ছিল একইভাবে রাজকীয়।
এখানে পূজার সঙ্গে যুক্ত ছিল সাহিত্যের আড্ডা,
গান, নৃত্য, এবং নাটকের মঞ্চায়ন।
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ঠাকুরবাড়ির পূজায় অংশগ্রহণ করতেন।
·
ঢাকার
জমিদার
বাড়ির
পূজা:
অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গের জমিদারবাড়িতেও পূজা অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে
উদযাপন করা হতো। ঢাকার
আহসান মঞ্জিলের দুর্গাপূজা বিখ্যাত ছিল। এখানে জমিদারদের
উদ্যোগে পূজা হত এবং
এতে রাজকীয় রীতি-নীতি মেনে
চলা হতো।
২. মণ্ডপ এবং প্রতিমা নির্মাণের
আড়ম্বর:
অবিভক্ত বাংলায় প্রতিমা নির্মাণ একটি অত্যন্ত শিল্পসম্মত
প্রক্রিয়া ছিল। কলকাতার কুমারটুলি,
যা আজও প্রতিমা তৈরির
জন্য বিখ্যাত, তখনকার দিনেও বাংলার সেরা শিল্পীদের কেন্দ্রবিন্দু
ছিল। এখানে প্রতিমার কারুকাজ এবং আকারের দিকে
বিশেষ নজর দেওয়া হতো।
প্রতিমা তৈরির কাজে নিখুঁততা এবং
সৌন্দর্য্যের ছাপ থাকত।
·
কুমারটুলির
প্রতিমা:
অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রসিদ্ধ প্রতিমা নির্মাণ কেন্দ্র ছিল কলকাতার কুমারটুলি।
এখানকার মৃৎশিল্পীরা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিমা সরবরাহ করতেন। প্রতিমার সৌন্দর্য এবং আকার-আয়তনের
জন্য কুমারটুলি পরিচিত ছিল। বড় বড়
জমিদার বাড়ির পূজায় এখানকার প্রতিমা আনা হতো।
·
ঢাকা
ও বরিশালের প্রতিমা শিল্প: পূর্ববঙ্গেও প্রতিমা শিল্প বিকশিত হয়েছিল। ঢাকার বংশাল এবং পুরনো ঢাকার
কিছু এলাকায় বিখ্যাত প্রতিমা নির্মাণকারীদের খুঁজে পাওয়া যেত। বরিশালের শিল্পীরাও
ছিলেন সুনামধন্য।
৩. সংস্কৃতি ও বিনোদন:
দুর্গাপূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল সাংস্কৃতিক বিনোদন
এবং বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন
জমিদার বাড়ি এবং বড়
বড় শহরগুলোতে নাটক, যাত্রা, পালাগান, কীর্তন এবং নানা ধরনের
সাংস্কৃতিক পরিবেশনার আয়োজন করা হতো।
·
নাট্য
এবং যাত্রা: জমিদার বাড়ির পূজার অন্যতম আকর্ষণ ছিল নাটক এবং
যাত্রা মঞ্চায়ন। বিশেষ করে পূজার অষ্টমী
বা নবমীর রাতে নাটকের আয়োজন
করা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
পরিবারের পূজায় নাট্যশিল্পের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো এবং সেখানে
বিদ্বজ্জনদের উপস্থিতি থাকত। এছাড়াও যাত্রা দলগুলির প্রথাগত মঞ্চায়ন ছিল পূজার সময়ের
বিশেষ আকর্ষণ।
·
কবিগান
এবং পালাগান: অবিভক্ত বাংলার মফস্বল শহর এবং গ্রামের
পূজাগুলোতে কবিগান এবং পালাগান ছিল
অন্যতম বিনোদন। একাধিক কবিয়ালরা একে অপরের সঙ্গে
পালা করে গান গাইতেন
এবং এই গানে দর্শক-শ্রোতারা ব্যাপক আনন্দ পেতেন।
·
কীর্তন
ও ধুনুচি নাচ: কীর্তন গান এবং ধুনুচি
নাচ ছিল পূজার প্রতিদিনের
অনুষ্ঠান। ধুনুচি নাচ দুর্গাপূজার একটি
বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যেখানে নাচের
মাধ্যমে মাতৃপ্রতিমাকে শ্রদ্ধা জানানো হতো।
৪. সমাজের বিভিন্ন স্তরের অংশগ্রহণ:
অবিভক্ত বাংলার পূজা ছিল সর্বজনীন
এবং এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের
পাশাপাশি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও আকৃষ্ট করত। জমিদার বাড়ির
পূজায় নিমন্ত্রণ পেতেন সমাজের প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ।
মুসলমানরা, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে, এই
পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন এবং অনেক সময়
তাঁরা প্রতিমা গড়ার কাজেও অংশ
নিতেন।
·
সামাজিক
মিলনমেলা:
পূজার সময়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী,
কৃষক, শ্রমিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, পণ্ডিত এবং সাধারণ মানুষ
সবাই একত্রিত হতেন। এই পূজা সমাজের
বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য
গড়ে তুলত। পূজার মণ্ডপগুলোতে আলোচনা, বিতর্ক, সাহিত্য পাঠ এবং সামাজিক
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা
হতো।
·
উৎসবের
বাজার
ও মেলা: দুর্গাপূজার সময় বাংলার বিভিন্ন
স্থানে মেলা বসত। এগুলোতে
হস্তশিল্প, খাদ্য, পোশাক এবং বিভিন্ন ধরনের
খেলনা বিক্রি হতো। বিশেষ করে
কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহের মতো
জায়গাগুলোতে মেলার বড় আয়োজন থাকত।
৫. ধর্মীয় আচার ও আড়ম্বর:
দুর্গাপূজার ধর্মীয় আচারগুলোও অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালিত হতো। পূজার চার
দিনই আলাদা আলাদা ধর্মীয় আচার এবং নিয়ম
মানা হতো। পূজার সময়
সিঁদুরখেলা, অঞ্জলি দেওয়া, কুমারী পূজা ইত্যাদি ছিল
প্রধান আচারগুলোর মধ্যে।
·
সিঁদুর
খেলা:
বিজয়া দশমীর দিনে সিঁদুর খেলা
ছিল অন্যতম আকর্ষণ। এই আচারটি মূলত
পূজার শেষ দিনে পালিত
হতো, যেখানে নারীরা দেবী দুর্গাকে বিদায়
জানাতে সিঁদুর দিয়ে একে অপরকে
আশীর্বাদ করতেন।
·
কুমারী
পূজা:
অবিভক্ত বাংলার পূজায় কুমারী পূজার প্রচলন ছিল। কুমারী মেয়েদের
মাতৃরূপে পূজা করা হতো
এবং দেবী দুর্গার এক
বিশেষ রূপ হিসেবে কুমারী
পূজাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো।
উপসংহার:
অবিভক্ত বাংলার দুর্গাপূজা ছিল শুধুমাত্র একটি
ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং
এটি ছিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক
এবং রাজনৈতিক এক মিলনমেলা। পূজা
উৎসবের সঙ্গে রাজনীতি, কৃষ্টি এবং সমাজ সংস্কারের
বিষয়ও জড়িত ছিল।
0 মন্তব্যসমূহ
আপনাকে জানাই ধন্যবাদ